Dream to BCS

Think positive, Be positive, Do positive

রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে প্রয়োজন বহুপক্ষীয় কূটনীতি

৩৮তম বিসিএস লিখিত প্রস্তুতি
রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে প্রয়োজন বহুপক্ষীয় কূটনীতি
-
মিয়ানমারের সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর সে দেশের সেনাবাহিনী, শাসকগোষ্ঠী, মৌলবাদী বৌদ্ধরা মিলে যে গণহত্যা, ধর্ষণ, হত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ করে চলেছে, তা থেকে মুক্তি পেতে নির্যাতিত রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আশ্রয় নিচ্ছে। এ পর্যন্ত প্রায় ১২ লাখ নির্যাতিত রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। এ সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার যখন দ্বিপক্ষীয় চুক্তি করেছিল, তখন অনেক বিশ্লেষক মন্তব্য করেছিলেন—এ চুক্তির কারণে কোনো প্রত্যাশিত ফল অর্জিত হবে না। তখন অনেকে বহুপক্ষীয় চুক্তির ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। বর্তমানে এই বহুপক্ষীয় নীতির প্রয়োজনীয়তা সবচেয়ে বেশি অনুভূত হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের নানা দ্বন্দ্ব-সংঘাত নিরসনে দ্বিপক্ষীয় নীতির কার্যকারিতার পূর্বশর্ত হলো, ওই বিষয়ে বিবদমান পক্ষগুলো সমান শক্তির অধিকারী হবে। অর্থাৎ দুটি বিবদমান রাষ্ট্র যদি অর্থনৈতিক বা সামরিক শক্তির বিবেচনায় একে-অপরের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়, তাহলে তাদের দ্বন্দ্ব নিরসনে যেকোনো চুক্তি কার্যকর হয়। কিন্তু যদি তাদের শক্তির প্রকৃতি, মাত্রা ও গুরুত্বের মধ্যে বড় পার্থক্য থাকে, তাহলে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি কার্যকর হয় না; বরং তা অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী রাষ্ট্রের স্বার্থ হাসিল করে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, বাংলাদেশ ও ভারত তাদের সাধারণ নদীর পানিবণ্টন নিয়ে ঐতিহাসিকভাবে যে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে আছে, তা নিরসন করতে এ পর্যন্ত যত আলোচনা বা সিদ্ধান্ত হয়েছে, তা ভারতের স্বার্থেই বেশি কাজে লেগেছে। একই কারণে দক্ষিণ এশিয়ার দ্বন্দ্ব মেটাতে সার্কের নীতিতে দ্বিপক্ষীয় তত্ত্ব গুরুত্ব পেয়েছে। ভারতের চাপাচাপিতে সার্ক-নীতিতে দ্বিপক্ষীয় তত্ত্ব যোগ করা হয়েছে।
অন্যদিকে বহুপক্ষীয় ফোরামে কোনো দ্বন্দ্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা শুরু হলে সেই ইস্যুতে বহুমুখী আলোচনা ও সংলাপের পরিবেশ তৈরি হয়। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে নির্মোহ আলোচনা ও বিতর্ক চললে ন্যায্যতা ও সুবিচারের পক্ষে আলোচনা এগোতে থাকে। আলোচনার প্ল্যাটফর্মটি মজবুত হতে থাকে এবং একসময় একটি জটিল বিষয়ও দ্রুত সমাধানের পথে এগোয়।
রোহিঙ্গা ইস্যুর সমাধানে বাংলাদেশ-মিয়ানমার চুক্তির দ্বিপক্ষীয় সুবিধা শতভাগ নিজের স্বার্থে ব্যবহার করে আসছে মিয়ানমার। গত বছরের (২০১৭) আগস্টে রোহিঙ্গা নির্যাতনের সবচেয়ে করুণ অধ্যায়ের সূচনা হলে মিয়ানমার বাংলাদেশের সঙ্গে দ্রুত দ্বিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষর করে এবং মিয়ানমার বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। তখন স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল, মিয়ানমার চুক্তি অনুযায়ী কাজ করবে না। বরং চুক্তিটিকে কালক্ষেপণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করবে। আশঙ্কাটি অবশেষে সত্য হলো।
রোহিঙ্গা নির্যাতনের করুণ দৃশ্যগুলো যখন বিশ্বমিডিয়ায় ছাপা হচ্ছিল, রোহিঙ্গা নির্যাতনের বিরুদ্ধে যখন বিশ্বময় মিয়ানমারবিরোধী জনমত তৈরি হচ্ছিল, ঠিক তখনই মিয়ানমার ইস্যুটি আড়াল করার জন্য বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি সই করে। এ চুক্তির বাহ্যিক অঙ্গীকার ছিল—নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের শিগগিরই নিরাপত্তা, মর্যাদা, নাগরিকত্ব প্রদান, কর্মসংস্থানসহ স্বদেশে ফিরিয়ে নেওয়া হবে। যদিও মজলুম রোহিঙ্গারা কখনো এ চুক্তিকে সম্মান করেনি বা মিয়ানমারকে বিশ্বাস করেনি, তবু তাদের বাইরে রেখেই চুক্তি সম্পন্ন করা হয়েছে।
লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ মহানুভব, উদার ও বন্ধুত্বপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতির দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে। উঁচুমানের বৈশ্বিক ইমেজ গড়ে উঠেছে বাংলাদেশের। কিন্তু চুক্তির বাস্তবায়ন না হলে অর্থাৎ রোহিঙ্গারা স্বদেশে ফিরে না গেলে যে মানবিক বিপর্যয়, নিরাপত্তা হুমকি ও মানব ব্যবস্থাপনার বোঝা বাংলাদেশের ওপর চাপবে তা বহন করা বাংলাদেশের পক্ষে সম্ভব হবে কি না, তা ভাবার সময় এখন।
কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ভূকৌশলগত ও আর্থ নিরাপত্তাগত কারণে মিয়ানমার আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক বৃহৎ শক্তিগুলোর কাছে সাম্প্রতিক সময়ে অতীব গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। ওই বৃহৎ শক্তিগুলোর বিনিয়োগ গন্তব্যে মিয়ানমার গুরুত্বপূর্ণ ভূমি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। চীন, রাশিয়া, ভারতসহ বিশ্বের ওই শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো মিয়ানমারের অভ্যন্তরে গভীর সমুদ্রবন্দর ও বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গঠনে তৎপর। বৃহৎ শক্তিগুলোর ভূ-কৌশলগত ও অর্থনৈতিক বিবেচনায় মিয়ানমার এখন এমন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে যে ওই রাষ্ট্রগুলোর কোনোটিই চাইবে না মিয়ানমার নাখোশ হোক। দ্বিতীয়ত. মিয়ানমার অত্যন্ত কৌশলে প্রচার করছে যে উদ্ধত ও মৌলবাদী রোহিঙ্গারা ‘আরসা’ নামের যে সংগঠন গড়ে তুলেছে; তার সদস্যদের আক্রমণ থেকে তাদের সেনাবাহিনীকে রক্ষার জন্যই তারা রোহিঙ্গাদের ওপর কঠোর হচ্ছে। তৃতীয়ত. মিয়ানমার সরকার ও সেনাবাহিনী বরাবর এটা অস্বীকার করে আসছে যে তারা রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন করছে। ফলে চীন, রাশিয়াসহ যে রাষ্ট্রগুলো অভ্যন্তরীণভাবে বিচ্ছিন্নতাবাদী ও ধর্মীয় আন্দোলনের অভিজ্ঞতার মধ্যে বিচরণ করছে, তারা সহজে মিয়ানমারের শঠতা, প্রতারণা ও মিথ্যা বক্তব্য বিশ্বাস করছে। সর্বোপরি বিশ্বসম্প্রদায়, আন্তর্জাতিক সংস্থা, বিশ্বনেতারা কেউই মিয়ানমারের অত্যাচারের বিরুদ্ধে জোর প্রতিবাদ জানাচ্ছে না অথবা রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছে না।
এমতাবস্থায় বাংলাদেশকে তার নিজের স্বার্থে রোহিঙ্গাবিষয়ক কূটনীতির পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে। মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পাদিত দ্বিপক্ষীয় চুক্তি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বহুপক্ষীয় কূটনীতির সৃজনশীল পথে পা বাড়াতে হবে। বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী গত বছর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ভাষণে পাঁচ দফা শান্তি প্রস্তাব পেশ করেছিলেন। এর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দফা হলো, মিয়ানমারের অভ্যন্তরে রোহিঙ্গা মুসলমানদের জন্য ‘নিরাপদ বলয় বা সেফ জোন’ তৈরি করতে হবে। তাঁর বক্তব্যের প্রায়োগিক বাস্তবতায় অগ্রাধিকার হলো বহুপক্ষীয় ফোরামের মাধ্যমে বহুমুখী আলোচনার দ্বারা বহুমুখী কূটনীতির চাপে মিয়ানমারকে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি বাস্তবায়নে বাধ্য করা। এর আগে আমি একাধিক লেখায় স্পষ্ট করেছিলাম যে মিয়ানমারকে তোষণ করে বা তোয়াজ করে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান করা যাবে না। বরং অব্যাহত চাপ সৃষ্টি করেই দেশটিকে কূটনৈতিক সমাধানে সম্মত করাতে হবে।
এর আগে বিশ্ব সংস্থা ও বিশ্ব রাষ্ট্রগুলো রোহিঙ্গা নির্যাতনকে জাতিগত নিধনযজ্ঞ বলে অভিহিত করলেও একে গণহত্যা হিসেবে প্রচার করেনি। ফলে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষকে আইনি চাপে রাখা যায়নি। কিন্তু জাতিসংঘসহ বিশ্বের বড় রাষ্ট্রগুলো এখন রোহিঙ্গা নির্যাতনকে গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবে প্রচার করা শুরু করেছে। মিয়ানমারে অসংখ্য গণকবরের সন্ধান পাওয়া গেছে এবং সেই অত্যাচারের চিহ্নগুলোও যে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ মুছে ফেলছে, এমন খবরও পত্রপত্রিকায় আসছে। জাতিসংঘ মানবাধিকার লঙ্ঘনের অসংখ্য প্রমাণ প্রচার করছে। এমতাবস্থায় বাংলাদেশের এখন সবচেয়ে বড় নীতিগত অগ্রাধিকার হলো বহুপক্ষীয় কূটনীতির আশ্রয়ে বাংলাদেশ-মিয়ানমার চুক্তির বাস্তবায়নের চেষ্টা করা। কয়েক দিন আগে মিয়ানমার সরকারের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিরা রোহিঙ্গা ইস্যুটির সমাধানে জাতিসংঘের সংশ্লিষ্টতার গুরুত্ব তুলে ধরেছেন। বাংলাদেশ তার গঠনমূলক ও কূটনীতির পারদর্শিতা দিয়ে মিয়ানমারের এ প্রস্তাব বিশ্ব ফোরামে দৃঢ়ভাবে তুলে ধরতে পারে। বিশেষ করে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীর নেতৃস্থানীয় দেশ হিসেবে বাংলাদেশ তার জাতিসংঘ-কূটনীতির মাধ্যমেও মিয়ানমারে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনী পাঠানোর উদ্যোগ নিতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, ইইউ, জার্মানিসহ অনেক রাষ্ট্র এরই মধ্যে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অবরোধ আরোপের প্রসঙ্গ তুলেছে। বাংলাদেশের হাতে মোক্ষম সুযোগ হলো, মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে নানা অবরোধ এবং মিয়ানমার রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বহুমুখী অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপের কূটনীতি প্রণয়ন করা। বাংলাদেশ মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পাদিত দ্বিপক্ষীয় চুক্তি বাস্তবায়নে বহুপক্ষীয় কূটনীতির সুযোগ নিতে পারে।
-
-
লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়