Dream to BCS

Think positive, Be positive, Do positive

ইরাক - ইরান যুদ্ধ যুদ্ধ সম্পর্কে জানতে পড়ুন

#আন্তজার্তিক
ইরাক - ইরান যুদ্ধ যুদ্ধ সম্পর্কে জানতে পড়ুন
ইরাক - ইরান যুদ্ধ ও আরব বিশ্বের বিভক্তি।
.
.

ইরাক-ইরান যুদ্ধ(১৯৮০-৮৮) ইতিহাসের এক কালো অধ্যায়। দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী এ যুদ্ধে ইরাক বা ইরান কোন পক্ষ জয়ী না হলে ও উভয় পক্ষই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।উভয় পক্ষই হারিয়েছিল তাদের প্রচুর সম্পদ ও দক্ষ জনবল।এ যুদ্ধের ফলে প্রমাণিত হয় আরব দেশ সমূহ ভাষা বা ধর্মের দিক থেকে এক হলে ও শিয়া, সুন্নি,কুর্দি ইত্যাদি সম্প্রদায় নিয়ে তাদের নিজেদের মধ্যে প্রখর দ্বন্দ্ব রয়েছে।অপরদিকে সাদ্দাম হোসেন নিজ দেশে বিষাক্ত রাসায়নিক গ্যাস নিক্ষেপ করে প্রায় পাঁচ হাজার বেসামরিক লোকদের হত্যা করেন। তার এই নির্দয় আচরণ সারা বিশ্বে প্রতিবাদের ঝড় তোলে। এই যুদ্ধের ফলাফল আরব বিশ্বে সুদূর প্রসারী প্রভাব ফেলে।
ইরাক ইরান যুদ্ধের পটভূমি:
★ইরাক ও ইরানের মধ্যে যুদ্ধের অন্যতম কারণ ছিল সীমান্ত বিরোধ নিয়ে। ইরানের দক্ষিন পূর্বাঞ্চলে শাতিল আরব বা ইউফ্রেটিস ও টাইগ্রিস নদীর অববাহিকা জলাভূমি ইরান ও ইরাকের মধ্যে সীমারেখা নির্ধারন করেছে। এই অঞ্চল লিয়ে দুই দেশের বিরোধ বহুদিনের। এই বিরোধ নিরসনের জন্য উভয় দেশের মধ্যে বহুবার চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে। যেমন,১৮৪৭ সনের এরজিরুম চুক্তি, ১৯১৩ সনের চুক্তি, ১৯৩০ ও ১৯৭৫ সনের আলজিয়ার্স চুক্তি।
★১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামি বিপ্লবের ফলে আয়াতুল্লাহ খোমিনির উত্থান ঘটে এবং ইরানকে একটি শিয়া মুসলিম রাষ্ট্র হিসাবে ঘোষণা করেন। ইরাকে শিয়া সম্প্রদায়ের মধ্যে ইরানের প্রভাব পড়তে পারে বলে সাদ্দাম আশংকা করেন।তাই ইরানকে সামরিক শিক্ষা দেওয়ার জন্য সাদ্দাম ইরান আক্রমণ করেন।
★ইরানের রাজনৈতিক ক্ষমতায় খোমিনির আগমন ঘটলে ইরানের সাথে তাদের বহুদিনের বন্ধু রাষ্ট্র আমেরিকার সাথে সম্পর্কের অবনতি ঘটে।ইরানের শাহ-কে আশ্রয় দানকারী আমেরিকাকে এক নম্বর শত্রু বলে ঘোষাণা দেয়। তেহরানের বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা আমেরিকান নাগরিকদের জিম্মি করে রাখে। এসব ঘটনার প্রেক্ষিতে ইরান ও আমেরিকা একে অপরের শত্রুতে পরিণত হয়। আর এ সুবর্ণ সু্যোগে সাদ্দাম ইরান আক্রমণ করেন।
★সাদ্দাম হোসেন একজন উচ্চ বিলাসী রাষ্ট্র নায়ক ছিলেন।১৯৯০ সালে কুয়েত আক্রমণের মধ্য দিয়ে তার এই উচ্চ বিলাসীর আরো ব্যাপক পরিচয় পাওয়া যায়। তাই সাদ্দাম হোসেন ১৯৮০ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর তারিখে ১৯৭৫ সালে আলজিয়ার্স চুক্তিকে বাতিল করেন এবং এর সাত দিনের মধ্যে ইরান আক্রমণ করেন।
★খোমেনি ক্ষমতা গ্রহণের পর ইরাকের কুর্দিদের সাদ্দামের বিরুদ্ধে প্ররোচিত করতে থাকেন। খোমেনি সাদ্দাম হোসেন ও তার বা'য়াছ পার্টি উভয়কে বিধর্মী ও ইসলামের শত্রু বলে আখ্যায়িত করেন এবং শিয়া ও কুর্দি উভয় সম্প্রদায়কে সাদ্দামকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করার আহবান জানান সংঘত কারণে সাদ্দাম ইরান আক্রমণ করেন।
ইরাক -ইরান যুদ্ধের সংক্ষিপ্ত কাহিনী :
১৯৮০ সালের ২২ সেপ্টেম্বর ইরাকের বিমান বাহিনী মেহরাবাদ বিমান বন্দর, আবাদানের তেল শোধনাগার এবং সীমান্তের বিভিন্ন ঘাঁটিসমূহে আক্রমণ চালায়। ২৭ সেপ্টেম্বর ইরাকী স্থল বাহিনী আহওয়াব,দেযফুল,কাসর শিরীন, নাফত-ই-শাহ এবং মেহেরান অবরুদ্ধ করে এবং এক মাসের মধ্যেই ইরানের পশ্চিমাঞ্চলের প্রায় দশ হাজার বর্গমাইল দখল করে নেয়। ইরাকের এই তীব্র আক্রমণের ফলে ইরান প্রথম দিকে শুধু আত্নরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে।কিন্তু ১৯৮১ সালের প্রথম দিকে ইরান ইরাকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে এবং আবাদান,বুস্তান ও বসরা অঞ্চলে আক্রমণ করে ইরাককে পশ্চাৎগামী হতে বাধ্য করে।শুরু হয় ইরাক -ইরানের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী এক যুদ্ধ।ইরান এ যুদ্ধে শাহ এর শাসনামলে আমেরিকা থেকে ক্রয় করা আধুনিক সমরাস্ত্র ব্যবহার করে।এবং খোমেনির অসীম জনপ্রিয়তা ও অনুপ্রেরণা ইরানকে আরো অজেয় করে তোলে।ফলে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত বেশিরভাগ যুদ্ধ ইরাকের ভূমিতে সংঘটিত হয় এবং ইরাককে আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থা নিতে হয়। আমেরিকায় নির্মিত ইরানী বিমান বাহিনীর আক্রমণে এই সময় বসরার নৌঘাঁটি এবং বাগদাদে ইরাকের শিল্পসমূহ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। ১৯৮৪ সালে ইরাক ইরানের তেল রপ্তানি ক্ষতগ্রস্থ করতে ইরান অভিমুখে আগত তেলবাহী জাহাজ সমূহকে আক্রমণ চালালে ইরান ও বসরা অভিমুখে আগত কুয়েত ও সৌদি ট্যাঙ্কার সমূহে আক্রমণ চালায়। এই প্রেক্ষাপটে সাদ্দাম হোসেন সরাসরি ওয়াশিংটনের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য কামনা করলে যুক্তরাষ্ট্র প্রথমে ইনটেলিজেন্স পরে কুয়েত ট্যাঙ্কারে যুক্তরাষ্ট্রের পতাকা বহন করে তেল সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে প্রচেষ্টা চালায়।১৯৮৮ সালের মাঝামাঝি সময়ে ইরান কুর্দিদের সহয়তায় ইরাকের কুর্দী শহর হালাবজা দখল করে নেয়। সাদ্দাম হোসেন তার সেনাবাহিনীকে হালাবজা পুর্ণখলের নির্দেশ দেন।এই আক্রমণে ইরাকি বিমান বাহিনী বিষাক্ত রাসায়নিক গ্যাস সমৃদ্ধ বোমা নিক্ষেপ করে,এবং তাতে কমপক্ষে ৫হাজার বেসামরিক লোক নিহত হয়। যুদ্ধে ইরাক পূর্বেও ইরানে রাসায়নিক গ্যাস নিক্ষেপ করেছিল বলে ইরান প্রতিবাদ করেছিল, কিন্তু নিজ ভুখন্ডে ইরাকের নির্দয় আচরণ বিশ্বে প্রতিবাদের ঝড় তোলে। এদিকে দীর্ঘ ৮ বছর থেকে চলতে থাকা যুদ্ধে ইরাক ও ইরান ক্লান্ত হয়ে অবশেষে ১৯৮৮ সনের ২০ আগস্ট ইউনাইটেড ন্যাশনস এর ৫৯৮ নং সিদ্ধান্তে স্বাক্ষর করে যুদ্ধ পরিসমাপ্তি ঘটায়।
ইরাক-ইরান যুদ্ধ ও আরব বিশ্ব :
ইরাক ও ইরান ১৯৮০ সালে নিজেদের মধ্যে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে আরব বিশ্বে এর ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। জর্ডানের বাদশাহ হোসেন ইরাকের প্রতি সমর্থন জানান। তাছাড়া মরক্কোর বাদশাহ হাসান, সৌদির বাদশাহ, কুয়েতের আমির ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের শেখ সাদ্দাম হোসেনকে সমর্থন জানান। আরব দেশসমূহ ইরানের বিরুদ্ধে পরিচালিত ইরাকেরর যুদ্ধ তহবিলে পর্যাপ্ত অর্থ সাহায্য দেয়। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে উপসাগরীয় দেশসমূহ ইরাককে ১৪ বিলিয়ন ডলার দিতে রাজি হয়। এরমধ্য সৌদি আরব ৬ বিলিয়ন, কুয়েত ৪ বিলিয়ন,সংযুক্ত আরব আমিরাত ৩ বিলিয়ন ও কাতার এক বিলিয়ন ডলার সাহায্য দেয়। সিরিয়ার হাফিজ আল আসাদ ও লিবিয়ায় গাদ্দাজি এ যুদ্ধে ইরানকে সমর্থন করেন। যার ফলে সাদ্দাম হোসেন এ দুটি দেশের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেন।
ইরাক-ইরান যুদ্ধ ও আমেরিকা :
ইরাক- ইরান যুদ্ধে আমেরিকা সরাসরি জড়িত না থাকলে ও ১৯৮৮ সালে যুদ্ধ শেষ হওয়ার পূর্বে আমেরিকান যুদ্ধ জাহাজ ইরাক আক্রমণে তৎপর হয়। একই সাথে যুক্তরাষ্ট্র তার মিত্র রাষ্ট্র সমূহে ইরানের উপর তেল নিষেধাজ্ঞা আরোপের আহবান জানায়। যদিও এসব কিছুর মূলে ছিল ইরানে আমেরিকার এতদিনের তাবেদার শাসক রেজা শাহের পতন ও খোমেনির আমেরিকা বিদ্বেষ ও তেহরানে জিম্মি সংকট।অপরদিকে ইরান দাবি করে এ যুদ্ধে আমেরিকা ইরাককে ইরানের বিরুদ্ধে প্ররোচিত ও সাহায্য করেছে। কিন্তু এ যুদ্ধের ফলে আমেরিকা কিছুটা হলে ও লাভবান হয়েছিল।ইরাক ও ইরান সীমান্ত উত্তেজনা শুরু হলে খোমেনী মনে করেন জিম্মি সংকটের সমাধান হওয়া প্রয়োজন। এই জিম্মি সংকট নিরসনে ব্যর্থতার কারণেই অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে অনেক সফলতা অর্জনের পর প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারকে ১৯৮০ সালের নির্বাচনে রোনাল্ড রিগ্যানের কাছে পরাজিত হতে হয়। অপরদিকে রোনাল্ড রিগ্যান ক্ষমতায় আসার পরর ইরাক -ইরান দ্বন্দ্বের ফলে খোমেনি জিম্মি সংকটের সমাধান করতে এগিয়ে আসেন।
ইরাক-ইরান যুদ্ধের ফলাফল ও প্রভাব:
ইরাক ইরান যুদ্ধের ফলাফল ও প্রভাব ছিল সুদূর প্রসারী।
★ ইরাক ইরান যুদ্ধ উভয় রাষ্ট্রের জন্য ধ্বংস ডেকে এনেছিল।পাশ্চাত্যর হিসাবে ৮ বছরের এ যুদ্ধে ৩৫০ বিলিয়ন ডলার ব্যয় হয়েছিল, পাঁচলক্ষ লোক নিহত এবং প্রায় এক বিলিয়ন আহত হয়েছিল। যুদ্ধে লোক সংখ্যার হিসাবে ইরানের ক্ষতি অধিক বলে মনে করা হয়।কিন্তু ইরাকের অবকাঠামো ও শিল্পকারখানা প্রায় ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল।
★দু'পক্ষই উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত প্রেট্রো ডলারের সঞ্চিত অর্থ নিঃশেষ করে দেউলিয়া পর্যায়ে চলে যায়। তবে ইরান বৃহদাকার দেশ হওয়ায় অল্প সময়ে তা কাটিয়ে উঠতে সমর্থ হয়। কিন্তু ইরাক উপসাগরীয় দেশসমূহ থেকে ঋণ নেওয়ার ফলে ইরাকের অর্থনীতিতে দীর্ঘ প্রভাব ফেলে।
★এ যুদ্ধে আরব বিশ্বের অধিকাংশ দেশ সাদ্দাম হোসেনকে সমর্থন করার ফলে সাদ্দাম হোসেন আরো উচ্চ বিলাসী হয়ে উঠেন। যার ফলে তিনি কুয়েত দখলের পরিকল্পনা শুরু করেন।
★এ যুদ্ধের ফলে ইরানের নিকট এ ধারণা শুরু হয় ইসরাইলের মতো তাদেরকেও আরব বিশ্বের অধিকাংশ রাষ্ট্র জঙ্গিবাদী রাষ্ট্র বলে মনে করে এবং তাদেরকে সামরিক দিক দিয়ে দুর্বল করতে চায়। যার ফলে ইরান হামাস,হিজবুল্লাহ ও হুতি বিদ্রোহিদের সমর্থন করতে শুরু করে।
★এ যুদ্ধের ফলে এ বিষয়টি প্রমাণিত হয় মধ্যপ্রাচ্যের অশান্তির জন্য শুধুমাত্র সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্র বা ইসরাইল একা দায়ী নয়। শিয়া, সুন্নি, কুর্দি এসব নিয়ে আরব বিশ্বে নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব রয়েছে।আর এসব দ্বন্দ্বের আবসান না ঘটলে মিশরের জামাল আবদেল নাসের যে প্যান আরবিজমের মাধ্যমে বা সৌদির বাদশাহ ফয়সাল যে প্যান ইসলামিজমের মাধ্যমে আরবদের সুসংঘটিত ও শক্তিশালী হিসাবে গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখতেন তা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়।
★সর্বোপরি ইরাক - ইরান যুদ্ধ ও আরব বিশ্বে দ্বন্দ্ব ইসরাইলের জিওনবাদ প্রতিষ্ঠার আরো একধাপ এগিয়ে নিয়ে গেল।