এলডিসি থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ : সম্ভাবনা , চ্যালেঞ্জ ও করণীয়
>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>
ভূমিকা :
বাংলাদেশ ১৯৭৫ সালে এলডিসির অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল।নতুন একটি দেশ হিসেবে এই অবস্থায় আসতে বাংলাদেশ কে অনেক আর্থসামাজিক ও ভু- রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হতে হয়েছিল।কিন্তু ক্রমান্বয়ে আমরা অনেকক্ষেত্রে উন্নতি অর্জন করেছি এবং এশিয়ার দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়েছি। গত মার্চ মাসের ১৬ তারিখ আমরা স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বের হবার যোগ্যতা অর্জন করেছি।এই যোগ্যতা অর্জনের খবরটি আনুষ্ঠানিক ভাবে বাংলাদেশকে জানিয়েছে জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি)।মাথাপিছু আয়ের পাশাপাশি সামাজিক বিষয়গুলোকে বিবেচনা করে সদস্য দেশগুলোকে স্বল্পোন্নত, উন্নয়নশীল আর উন্নত এই তিন ভাগে ভাগ করে সিডিপি।প্রতি তিন বছর পরপর সিডিপি দেশ গুলোর পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে।তিনটি সূচকের ভিত্তিতে এটা পর্যালোচনা করা হয়।এগুলো হল মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ ও অর্থনৈতিক ঝুঁকি।এলডিসি থেকে বের হতে কমপক্ষে দুইটিতে নির্ধারিত মান অর্জন করতে হয়।
।
এলডিসি থেকে উত্তরণের শর্তঃ
অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি বিবেচনা করে দেখা যায় বাংলাদেশ তিনটি সূচকেই নির্ধারিত মান অর্জন করেছে।পরিকল্পনা মন্ত্রনালয়ে তথ্যানুযায়ী মানগুলো নিচের চার্টে দেখানো হল।
সূচক প্রয়োজনীয় পয়েন্ট বাংলাদেশের অর্জন
মানবসম্পদ সূচক ৬৬ ৭২.৮
অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা ৩২ এর কম ২৫
মাথাপিছু আয় ১২৩০ ১২৭২
২০১৮ সালের পর্যালোচনায় যোগ্যতা অর্জন করলে পরের তিন বছর অর্থাৎ ২০২১ সাল পর্যন্ত নির্ধারিত সূচকে একই অবস্থা বজায় রাখতে হবে।এরপর উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের সুপারিশ করবে জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিভাগ ।
তিন বছর পর ২০২৪ সালে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা দেয়া হবে।
তবে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের যে সুবিধা ভোগ করছে তা ২০২৭ সাল পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে।
।
যেভাবে উত্তরণ ঘটবেঃ
২০১৮ সাল জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদের উন্নয়ন কমিটি(সিডিপি) তাদের ত্রিবার্ষিক পর্যালোচনায় বাংলাদেশকে এলডিসি থেকে উত্তরণের যোগ্য হিসেবে ঘোষণা দেয়।
পরবর্তী তিন বছর UNCT ঝুঁকির চিত্র তৈরি করবে এবং বাংলাদেশকে খসড়া সরবরাহ করবে। CDP এর ত্রিবার্ষিক পর্যালোচনার সাথে বাংলাদেশের জাতীয় পরিসংখ্যানের তুলনা করবে। জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিভাগ (DESA)এর প্রভাব মূল্যায়ন করবে এবং খসড়া বাংলাদেশকে পাঠাবে। খসড়ায় দুটি বিষয় থাকবে। LDC তে না থাকলে এবং LDC কেন্দ্রিক সহায়তা প্রভাব থেকে বঞ্চিত হলে তার প্রভাব মূল্যায়ন করতে হবে। পরবর্তী পর্যালোচনা বৈঠকের আগে CDP এর বিশেষজ্ঞ গ্রুপের বৈঠকে বাংলাদেশ দুই খসড়ার উপর নিজস্ব মতামত উপস্থাপন করবে।
২০২১ সাল সব ঠিক থাকলে দ্বিতীয়বার যোগ্যতা নিশ্চিত করবে CDP।জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদ (ECOSOC) এরকাছে LDC থেকে উত্তরণের সুপারিশ করবে CDP। CDP এর সুপারিশ অনুমোদন করবে ECOSOC। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ এ সুপারিশ বিবেচনায় নেবে।
পরবর্তী তিন বছর বাংলাদেশ অনুরোধ করলে জাতিসংঘ লক্ষ্যমাত্রা ভিত্তিক সহায়তা দিবে। উন্নয়ন ও ব্যবসায়িক সহযোগীরা উন্নয়নে সাহায্য করতে বাংলাদেশের সাথে আলোচনা করবে। CDP বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়া পর্যালোচনা করে প্রতিবছর ECOSOC এর কাছে রিপোর্ট দিবে।
পরবর্তী ছয় বছর ২০২৪ সালে LDC থেকে উত্তরণ কার্যকর হবে। তবে ছয় বছর পর্যালোচনায় থাকবে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ কী করবে, উন্নয়ন ও বাণিজ্য সহযোগীদের দায়িত্ব কী হবে এবং CDP এর কাজ কী হবে তা নির্দিষ্ট রয়েছে। বাংলাদেশ একটি রুপান্তর কৌশল বাস্তবায়ন করবে। বাংলাদেশ স্বেচ্ছায় CDP এর কাছে এ বিষয়ে বার্ষিক প্রতিবেদন দিবে। তিন বছর পর CDP ত্রিবার্ষিক পর্যালোচনার জন্য প্রতিবেদন দিবে। CDP দুটি ত্রিবার্ষিক পর্যালোচনা করবে। বাংলাদেশের রুপান্তর কৌশল বাস্তবায়নে উন্নয়ন সহযোগী ও ব্যবসায়িক অংশীদাররা সাহায্য করবে। CDP উন্নয়ন পর্যালোচনা করবে এবং প্রতি বছর ECOSOC এর কাছে প্রতিবেদন দিবে। এছাড়া দুটি ত্রিবার্ষিক পর্যালোচনা ECOSOC এর কাছে দিবে।
।
এলডিসি থেকে বের হওয়া দেশসমূহঃ
এলডিসির দেশগুলোর তালিকা করার পর গত ৪৭ বছরে মাত্র ৫টি দেশ এই তালিকা থেকে বের হতে পেরেছে।
দেশ বের হওয়ার বছর
বতসোয়ানা ১৯৯৪
কেপভারদে ২০০৭
মালদ্বীপ ২০১১
সামোয়া ২০১৪
নিরক্ষীয় গিনি ২০১৭
বর্তমানে এলডিসি ভুক্ত দেশ মোট ৪৭টি। ২০১৫ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে ১০ টি দেশ তালিকা থেকে বের হবে। নিরক্ষীয় গিনি ২০১৭ সালে বের হয়েছে।ভানুয়াতু এবং এঙ্গোলা যথাক্রমে ২০২০ এবং ২০২১ সালে বের হবে। কিরিবাতি, সাওটোমে প্রিন্সিপে এবং সলোমন দ্বীপপুঞ্জ ২০১৫ সালে উত্তরণের জন্য যোগ্য বিবেচিত হয়েছে।মায়ানমার এবং লাওস, বাংলাদেশের সাথে এলডিসি তালিকা থেকে বের হবার যোগ্যতা অর্জন করেছে। নেপাল, পূর্ব তিমুর ও টুভ্যালু এলডিসি থেকে বের হতে সুপারিশের জন্য পর্যালোচনায় আছে।
।
এলডিসি থেকে বের হবার চ্যালেঞ্জ সমূহঃ
এলডিসি থেকে উত্তরণের কারণে ২০২৭ সালের পর শুল্কমুক্ত সুবিধা উঠে যাবে।তখন বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের টিকে থাকতে হলে দক্ষতা বৃদ্ধির সাথে সাথে উৎপাদন খরচ কমাতে হবে।সিপিডি'র চেয়ারম্যান রেহমান সোবাহান তার বক্তব্যে বলেনঃ
"সুতরাং এলডিসি থেকে উত্তরণ নয় তার স্থায়িত্ব রাখাই হবে মূল চ্যালেঞ্জ।"
World Bank এর ঢাকা কার্যালয়ের মূখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন
।
এলডিসি থেকে বের হবার সুবিধাঃ
• উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হওয়া মর্যাদার বিষয় উল্লেখ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড আতিউর রহমান বলেন
• বিশ্বের সব দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছে বাংলাদেশের গুরুত্ব বেড়ে যাবে।
• সরকারি বেসরকারি প্রোজেক্টে বিনিয়োগের যে ঝুঁকি বিবেচনা করা হয় তা অনেকাংশে কমে যাবে।
• বিদেশি বিনিয়োগের সম্ভবনা বাড়বে।
• ইউরোপীয় বাজারে কোটামুক্ত বাণিজ্য করতে পারবে।
• জিএসপি প্লাস সুবিধা পাবে।তবে এর জন্য সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে।
।
চ্যালেঞ্জ মোকাবেলাঃ
বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে পাওয়া ঋণ এর সুদের হার বেড়ে যাবে।
রপ্তানি পণ্যের বাজার সংকুচিত হবে।বিশেষ করে নতুন পণ্য নিয়ে ঝুঁকিতে পড়তে হবে।রপ্তানিবাজারে নতুন নতুন শর্ত যুক্ত হতে পারে।
জনশক্তি রপ্তানিতে প্রাপ্ত সুবিধা বাংলাদেশ হারাবে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেয়া জিএসপি সুবিধা অব্যাহত থাকবে না।
৪৭ টি দেশ মোট ১৩৬ ধরনের সুযোগ সুবিধা ভোগ করে বিশেষ করে জলবায়ু অর্থায়ন, রুলস অব অরিজিন বাজারে অগ্রাধিকারভিত্তিতে সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতির ক্ষেত্রে সফটলোন এবং অনুদান অনেক বড় ভুমিকা পালন করে।অনেক মেগা প্রোজেক্ট এসব অনুদানে চলছে।যদি বাংলাদেশ এলডিসি থেকে বেড়িয়ে যায় তবে দিনে দিনে ঋণ এর পরিমান বাড়বে আর অনুদান কমতে থাকবে।২০১৬- ১৭ অর্থবছরে বাংলাদেশে অনুদানের পরিমান ছিল ১২.৫% আর ঋণ এর পরিমান ছিল ৮৭.৫%। এসব ঋণ এর জন্য বাংলাদেশকে উচ্চহারে সুদ দিতে হতে পারে।
উন্নয়নমূলক কাজের ক্ষেত্রে টেকনিক্যাল সহযোগিতা থেকে বঞ্চিত হবে।
।
চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় করণীয়:
বিশ্ববাজারে টিকে থাকতে হলে নীতি সংস্কারের প্রয়োজন হতে পারে।সেটার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।
ব্যক্তিগত খাতে বিনিয়োগ তাৎপর্যপূর্ণভাবে বাড়াতে হবে।এর জন্য সরকারকে জ্বালানিসহ অবকাঠামোগত সুবিধা দিতে হবে।এক্ষেত্রে ফরেন ডিরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট (এফডিআই) বাড়াতে হবে।
বাংলাদেশের অর্থনীতি সুরক্ষিত করার জন্য প্রচেষ্টা বাড়াতে হবে। পরবর্তীতে দেশের অর্থনৈতিক অস্তিতিশীল না হয় সেক্ষেত্রে তৎপর হতে হবে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ বা আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের সাথে সমন্বয় বাড়াতে হবে।সেজন্য দেশের নীতিনির্ধারকদের পরিপক্বতা বাড়াতে হবে।
অর্থনৈতিক কূটনীতিতে পররাষ্ট্রনীতিকে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দিতে হবে।
ইউরোপের বাজারে জিএসপিপ্লাস পাওয়ার জন্য জোর উদ্যোগ নিতে হবে।
দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন অব্যাহত রাখতে হবে।
উন্নয়নশীল দেশের সাথে বানিজ্য জোট গঠন এবং ন্যায্যতার ভিত্তিতে সার্বিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড নির্ধারণ করতে হবে।
রেমিট্যান্স বাড়ানোর চেস্টা করতে হবে, সবস্তরে আইসিটির ব্যবহার বাড়ানোসহ উন্নয়নের আরো অংশীদার খুজতে হবে।
কাঠামোগত ঝুঁকি যেমন দারিদ্র, অসাম্য, কম অর্থনৈতিক মূলধন এবং দুর্বল অর্থনৈতিক পরিচালনা সামলাতে হবে।
অনাকাঙ্ক্ষিত ঝুঁকি যেমন আবহাওয়া পরিবর্তন, উগ্রপন্থীদের সন্ত্রাস, বর্তমান রোহিঙ্গা সমস্যা এগুলোকে গভীরভাবে মোকাবেলা করতে হবে।
গভীর সমুদ্রবন্দর করতে হবে আর বর্তমান সমুদ্রবন্দর গুলোর কার্যকারিতা বাড়াতে হবে।
অনেক বেশি শক্তি উৎপাদন করতে হবে।নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ এর ব্যবস্থা করতে হবে।বিদ্যুৎবিভ্রাট শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনতে হবে।
রাস্তাঘাটের উন্নয়ন করতে হবে।পণ্য পরিবহনের পথগুলোকে যানজটমুক্ত করতে হবে।
অনেকগুলো মেগাপ্রোজেক্ট চালু আছে।সেগুলো যথাসময়ে শেষ করার জন্য বিদেশি বিনিয়োগকারিদের আকৃষ্ট করতে হবে।
।
উপসংহারঃ
উন্নয়নশীল দেশ হওয়া মানে বাংলাদেশকে আর কেউ বলতে পারবেনা আমরা দুর্বল জাতি।বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে।আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশের গুরুত্ব বাড়বে।কিন্তু এটা অর্জন করতে হলে বাংলাদেশকে অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে।এটা করতে ব্যর্থ হলে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে যাবে।
//
সংগৃহীত ও সম্পাদিত