বাংলাদেশ-চীন-ভারত-মিয়ানমার অর্থনৈতিক কোরিডোরকে এগিয়ে নিতে কিছুদিন আগে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রী দিপু মনি তার চীনা প্রতিপক্ষ ওয়াং ই'র সঙ্গে বেইজিংয়ে দেখা করেন। এই উদ্যোগ দক্ষিণ এশিয়ায় পাকিস্তানের সঙ্গে চীনের বিশেষ সহযোগিতা ও সাম্প্রতিক এশীয় সম্মেলনগুলোর অনুগমন, যেটিতে প্রেসিডেন্ট জি জিনপিং ও প্রধানমন্ত্রী লি কিকিয়াং উভয়েই "নতুন সামুদ্রিক সিল্ক রোড" এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে গভীরতর সহযোগিতাকে প্রেরণা দিয়ে আসছেন। স্বল্প-পরিচিত হলেও চীনের আঞ্চলিক ভারসাম্যে বাংলাদেশের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
১৯৪৭ সালে বাংলা ও বৃটিশ ভারত বিভক্তিতে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় অংশ হিসেবে বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল। তিন দশকেরও বেশি সময় অর্থনৈতিক অবহেলা ও রাজনৈতিক প্রান্তিকীকরণের পর বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করেছিল ১৯৭১ সালে।
ভঙ্গুর ধর্মনিরপেক্ষ বহুদলীয় গণতন্ত্র লুণ্ঠিত হয়েছিল রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা, দুর্ভিক্ষ ও সামরিক অভ্যুত্থানে। তুলনামূলক স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির পথকে বিস্তৃত করতে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার হয়েছিল ১৯৯১ সালে। ১৬ কোটিরও বেশি জনসংখ্যা নিয়ে বাংলাদেশ আজ দরিদ্র, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা অধিকন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের কাছে ভেদ্য। এখনো এর রয়েছে প্রবৃদ্ধির বিশাল সম্ভাবনা। বাংলাদেশের অর্থনীতি তৈরি পোশাক খাতের উপর নির্ভরশীল। এই দেশের অর্থনীতি ইউরোপ ও আমেরিকায় ধীর রপ্তানি ও রেমিট্যান্সের কারণে ভোগে। উন্নত ও উদীয়মান দেশগুলোর নির্মাণ মন্থরতায় যেটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
২০১৩ সালে বাংলাদেশের মোট দেশজ উত্পাদন প্রবৃদ্ধির গতি হ্রাস পেয়েছিল টানা দ্বিতীয় বছরের মতো। নেমে এসেছে ৬ শতাংশে। শ্রম শক্তির অর্ধেক ছিল কৃষি খাতে নিযুক্ত, যেটিতে স্থির খাদ্যশস্য উৎপাদনের কারণে প্রবৃদ্ধি নেমে এসেছিল ২ দশমিক ২ শতাংশে। ধর্মঘট ও রাজনৈতিক সহিংসতার কারণে পরিসেবা প্রবৃদ্ধি কমে দাঁড়িয়েছিল ৬ দশমিক ১ শতাংশ। কারখানায় আগুন ও রাজনৈতিক অশান্তির সম্মিলন বাংলাদেশের ২২ বিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাক শিল্পকে অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দিচ্ছে।
তবে বর্তমানে অর্থনীততি বেশ ভাল অবস্থানে আছে।
বাংলাদেশ আজ যেখানে, চীন সেখানে ছিল ১৯৮০'র দশকের গোড়ায়, ৩০ শতাংশ নগরায়নের হার বিবেচনায়। বাংলাদেশ সঠিক নীতির সাহয্যে প্রবৃদ্ধি ও উন্নতির যুগ সূচনা করতে পারে। ভুল নীতি দিয়ে এটি ভুগতে পারে স্থবিরতা ও দারিদ্র্যের যুগে।
বাণিজ্য ও সাংস্কৃতিক বিনিময়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও চীনের রয়েছে সমৃদ্ধ ইতিহাস। যুদ্ধপরবর্তী যুগে চীনা প্রধানমন্ত্রী ঝাউ এনলাই বহুবার পূর্ব পাকিস্তান সফরে এসেছিলেন এবং তার দলটির দৃঢ় সম্পর্ক ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদী নেতাদের সঙ্গে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় চীন সমর্থন করেছিল পাকিস্তানকে। স্বাধীনতার পরেও বাংলাদেশ ঘনিষ্ঠ ছিল ভারত এবং তার মিত্র সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে, যেটি কিনা ছিল চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান প্রতিপক্ষ।
১৯৭০'র দশকের মাঝামাঝি সময়ে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পিতা শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা সামরিক সরকার ডেকে এনেছিল, যেটি দেশকে ইন্দো-সোভিয়েত মৈত্রীর কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নিতে শুরু করেছিল। ইতোমধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল ঢাকা ও বেইজিংয়ের মধ্যে। অভ্যন্তরীণ বিক্ষোভ সত্ত্বেও বাংলাদেশের পরবর্তী সরকারগুলো চীনের সঙ্গে গভীর সম্পর্ককে টিকিয়ে রেখেছিল।
২০১২ সাল নাগাদ বাংলাদেশের সবচে' গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য সহযোগী ছিল যুক্তরাষ্ট্র। এর পরের দুটি অবস্থান জার্মানী ও ব্রিটেনের। পক্ষান্তরে ভারত ও সিঙ্গাপুরকে পেছনে ফেলে চীন ছিল সর্ববৃহত্ আমদানি সহযোগী। কিন্তু হতে পারে, এই বিষয়গুলোর পরিবর্তন ঘটছে। এর মধ্যে ২০১২ সালে বাংলাদেশ ও চীনের বাণিজ্য ৮শ' কোটি ডলার অতিক্রম করে। আগের বছরের চেয়ে ৩৬ শতাংশ বেড়ে ২০১৩ সালের প্রথম প্রান্তিকে ট্রেড ভলিউম ৩৩০ কোটি ডলারে পৌঁছে। যদিও চীন-পাকিস্তান সম্পর্ক এ অঞ্চলে ভারতীয় শক্তির ভারসাম্য বজায় রাখতে ব্যবহূত হয়েছে, কিন্তু বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক অনেকটা নিরপেক্ষ। ভারতের কাছে এক প্রকার সেতু। হু জিনতাও এ সম্পর্ককে বৈশিষ্ট্য প্রদান করেছেন "উন্নয়নের জন্য সর্বাত্মক সহযোগিতা" হিসেবে। অধিকন্তু প্রতিরক্ষা সুবিধা যেহেতু দ্বি-পাক্ষিক মৈত্রীর একটা গুরুত্বপূর্ণ উপাদানে রূপ নিয়েছে, গুরুত্বারোপ করা হয়েছে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী ও চীনের সহযোগিতার ওপর।
দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা সার্ক-এর একটি প্রতিষ্ঠাতা সদস্য বাংলাদেশ। চীন বাংলাদেশের আমন্ত্রণে এর পর্যবেক্ষক। চীন ও বাংলাদেশ উভয়েই বৃহত্তর আঞ্চলিক সহযোগিতাকে নিরাপত্তা ও উন্নতির কেন্দ্রীয় বিষয় হিসেবে দেখে।
১৯৯০'র দশকের শেষ দিক থেকে ইউনান প্রদেশের রাজধানী কুনমিংকে চীনা বাজারের প্রবেশপথ ও আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর লিংকেজ হিসেবে দেখছে বাংলাদেশ। পক্ষান্তরে চীন বাংলাদেশকে দেখে ভারতের সঙ্গে সংযোগের নল হিসেবে। পাকিস্তানে ব্যাপক নির্মাণ প্রকল্পে জড়িত রয়েছে চীন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে চীনা সহযোগিতা কামনা করেছেন। এই অঞ্চলে চীনের বাড়ন্ত সামুদ্রিক শক্তির প্রেক্ষিতে ওয়াশিংটনের সন্দেহর কারণে তিনি জানিয়েছেন, কেবলমাত্র চীনই নয়, সকল প্রতিবেশী দেশ এটি ব্যবহার করতে পারবে।
বাংলাদেশ, চীন, ভারত ও মিয়ানমারকে নিয়ে এই চতুর্দেশীয় উপদল গঠন অথবা বিসিআইএম অর্থনৈতিক কোরিডোরের প্রচেষ্টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনটি উদীয়মান ব্লকের কেন্দ্রবিন্দুরূপে এটিকে দেখা যেতে পারে। সেই তিনটি হল দক্ষিণ, পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া। এই কোরিডোর চীনের বর্ধিষ্ণু সামুদ্রিক শক্তিরও প্রতিফলন ঘটায়। তারা সমুদ্রপথে প্রতিপক্ষ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হচ্ছে, যে পথগুলো মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার জ্বালানি সম্পদের সঙ্গে চীনকে যুক্ত করেছে।
বিসিআইএম-এর সমালোচরা বিশ্বাস করেন, এই "মুক্তার হার" চীনের আঞ্চলিক প্রাধান্যের স্প্রিংবোর্ড রূপে কাজ করতে পারে। বাংলাদেশ ও মিয়ানমার, অবশ্যই চীন এবং সম্ভবত ভারতও এই অর্থনৈতিক কোরিডোর নিয়ে অনেক আশাবাদী-দেখছে শান্তি ও স্থিতিশীলতার সম্ভাবনাময় নিশ্চয়তা হিসেবে। যা প্রবৃদ্ধি ও সমৃদ্ধিকে ভবিষ্যতে সহযোগিতা যোগাবে।
-
Niloy Sen Gupta