◇'কোরিয়া উপদ্বীপে ‘শান্তির সুবাতাস’◇
____________________________________
গত প্রায় পাঁচ দশক ধরে কেবল বিচ্ছিন্নতা ও সম্পর্কের টানাপোড়েনের জেরে উত্তেজনার উত্তাপই ছড়াচ্ছিলো কোরীয় উপদ্বীপে। হঠাৎ হঠাৎ উসকানিতে সীমান্তে মরণাস্ত্রের ঝনঝনানি নির্ঘুম রাখছিলো উপদ্বীপ ও তার আশপাশের বাসিন্দাদের। গত বছরের শুরু থেকে এ বছরের শুরু পর্যন্ত উপদ্বীপটি ঘেঁষে সামরিক যুদ্ধযানের মহড়া যে আতঙ্ক ছড়াচ্ছিলো, তাতে পরমাণু বোমা নিক্ষিপ্ত হলে কতো প্রাণহানি হতে পারে, সেই ‘হিসাব’ও কষা হচ্ছিলো। তবে সেই ‘দুঃসময় শেষ হতে চলেছে’। উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার দুই প্রেসিডেন্ট কিম জং-উন ও মুন জে-ইন দু’দেশের সীমান্তগ্রাম ‘পানমুনজমে’ এক ঐতিহাসিক বৈঠকে মিলিত হয়েছেন। সেই বৈঠকের পর দু’জনের স্বাক্ষরিত ঐতিহাসিক ঘোষণায় এখন ‘শান্তির সুবাতাস’ বইছে কোরিয়া অঞ্চলে।
গতকাল শুক্রবার (২৭ এপ্রিল) ‘সুপ্রভাতেই’ এ শান্তির বার্তা নিয়ে সীমান্তগ্রাম ‘পানমুনজমে’ পা রাখেন কিম ও মুন। ‘প্রতিপক্ষ’র অবস্থান থেকে আসন ছেড়ে প্রথমে উত্তরের ‘যুদ্ধংদেহী’ প্রেসিডেন্ট কিমই স্বদেশের সীমারেখা পেরিয়ে ‘পানমুনজমে’ এগিয়ে যান। সেখানে তাকে স্বাগত জানান দক্ষিণের প্রেসিডেন্ট মুন। তখন অভাবনীয়ভাবে কিম আমন্ত্রণ জানান মুনকে, জবাবে দক্ষিণের নেতা সীমারেখা টপকে উত্তরের মাটিতে পা রাখেন। উচ্ছ্বসিত দুই প্রেসিডেন্ট এগিয়ে যান পরস্পরের দিকে, করেন করমর্দন। এরপর হাত ধরেই কিমকে সীমারেখা পার করে দক্ষিণে নিয়ে যান মুন। কোরিয়া যুদ্ধের পর উত্তরের প্রথম কোনো নেতা হিসেবে দক্ষিণে পদার্পণ করা কিমকে দেওয়া হয় গার্ড অব অনার। তারপর দু’জনে হাত ধরেই একটি বাড়িতে বৈঠক করতে যান।দুই নেতা কর্মকর্তাদের নিয়ে যে বাড়িটিতে এই ঐতিহাসিক বৈঠক করেন, সেটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘পিস হাউস’ বা শান্তির বাড়ি। এই শান্তির বাড়িতে বৈঠকের পর কিম ও মুন অসামরিকীকৃত অঞ্চলে (ডিমিলিটারাইজড জোন-ডিএমজেড) গাছের চারা রোপণ করেন। চারা রোপণকালে কিম ব্যবহার করেন দক্ষিণের মাটি, আর মুন ব্যবহার করেন উত্তরের মাটি। এরপর দুই নেতা ডিএমজেড দিয়ে হেঁটে একটি ফুটওভার ব্রিজে পাতা আসনে বৈঠক করেন। পুরো ব্রিজটি সাজানো হয় ঐক্যের প্রতীক নীল রঙে। এখানে প্রায় ৩০ মিনিট দু’জনে একান্তে আলাপ করেন।
এই বৈঠকের পর কিম ও মুনের স্বাক্ষরিত একটি ‘যৌথ ঘোষণা’ দেওয়া হয়। এই ঘোষণায়ই কোরীয় উপদ্বীপের বাসিন্দাদের দেওয়া হয় দশকের পর দশক ধরে কাঙ্ক্ষিত অনেক সুখবর। যার মধ্যে ছিল কোরিয়া অঞ্চলে দীর্ঘমেয়াদে শান্তি প্রতিষ্ঠায় পরমাণু নিরস্ত্রীকরণে মতৈক্য এবং কোরীয় যুদ্ধের আনুষ্ঠানিক অবসানে ও সংঘাত বন্ধে আনুষ্ঠানিক চুক্তির প্রক্রিয়ার কথা। ঘোষণার প্রধান বিষয়গুলো হলো---
>> ১. পরমাণুমুক্ত কোরীয় উপদ্বীপ গড়ে তোলার অভিন্ন লক্ষ্য অর্জনে পুরোপুরি পরমাণু নিরস্ত্রীকরণে সম্মত দুই দেশ।
>> ২. প্রায় ৬৫ বছর আগে শেষ হওয়া কোরীয় যুদ্ধের আনুষ্ঠানিক অবসানে এবং সংঘাত বন্ধে শান্তি চুক্তি করবে দু’পক্ষ। যেখানে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনসহ বিশ্ব ও আঞ্চলিক শক্তিগুলোর সহযোগিতা থাকবে।
>> ৩. উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার সীমান্তবর্তী যৌথ শিল্পাঞ্চল ‘কায়েসংয়ে’ দু’পক্ষের ‘লিয়াজোঁ’ অফিস গঠিত হবে। এই শিল্পাঞ্চলে কার্যক্রম রয়েছে দুই কোরিয়ারই। সংঘাতময় পরিস্থিতিতে আগে এই শিল্পাঞ্চল বন্ধ করে দেওয়া হতো।
>> ৪. জাতীয় পুনর্মিলন ও ঐক্যের স্বার্থকে সর্বাগ্রে বিবেচনার জন্য দু’পক্ষ সর্বস্তরে সহযোগিতা, বিনিময়, সফর ও যোগাযোগকে আরও বেশি উৎসাহিত করবে।
>> ৫. দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুন জে-ইন চলতি বছরের শেষ দিকেই পিয়ংইয়ং সফর করবেন। তার আগে মে অথবা জুনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠক করবেন উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট কিম জং-উন।
>> ৬. দু’পক্ষ আগামী ১৫ জুন একটি বিশেষ সভায় বসবে।
>> ৭. উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়া এশিয়ান গেমসের মতো আন্তর্জাতিক ক্রীড়া আসরে যৌথভাবে অংশ নেবে। এবার ১৮ আগস্ট থেকে ২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ইন্দোনেশিয়ায় বসবে এশিয়ান গেমসের আসর।
>> ৮. কোরীয় উপদ্বীপের বিভাজনে আলাদা হয়ে যাওয়া দুই দেশের নাগরিকদের পরিবারের স্বজনদের সঙ্গে পুনর্মিলনে প্রতিবছরের ১৫ আগস্ট জাতীয় অনুষ্ঠান হবে সীমান্তে।
>> ৯. সীমান্তে হামলা বা সামরিক কর্মকাণ্ড বন্ধ এবং উসকানিমূলক যে কোনো ধরনের প্রচার-প্রচারণা বন্ধ করবে দু’পক্ষ।
>> ১০. দু’দেশের প্রতিরক্ষামন্ত্রী পর্যায়ে নিয়মিত বৈঠক হবে।
এই ঘোষণার পর উচ্ছ্বসিত বিবৃতিতে উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট কিম বলেন, ‘আমাদের ইতিহাসে নতুন অধ্যায় রচিত হলো। আমরা সবাই এই মুহূর্তের জন্য দীর্ঘ-প্রতীক্ষায় ছিলাম। আশা করি দুই কোরিয়া আবার ‘পুনর্মিলিত’ হবে। শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য যে ঐতিহাসিক আলোচনা হয়েছে, তার বাস্তবায়ন আর দীর্ঘায়িত হতে পারে না।’
.
উল্লেখ্য, বিশ্ব ভূখন্ডে ”কোরিয়া” নামক একটি দেশ ছিল । কিন্তু দ্বিতীয় ব্শ্বিযুদ্ধে পর অর্থাৎ ১৯৪৫ সালে জাপানী বাহিনীর আত্নসমর্পণের পর কোরিয়া বিভাজিত হয় । এসময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সৌভিয়েত ইউনিয়ন ৩৮তম সমান্তরেখা অনূযায়ী বিভক্ত করে দক্ষিণ কোরিয়াকে মার্কিনীদের অধীনে এবং উত্তর কোরিয়াকে সৌভিয়েত ইউনিয়নের অধীনে নিয়ে যায় ।
.
●●চীন - উত্তর কোরিয়া সম্পর্ক : চীন ও উত্তর কোরিয়া ১৯৪৯ সালের ৬ অক্টোবর পরস্পর কুটনৈতিক স্বীকৃতি প্রদান করে । ১৯৫০ সালের মে মাসে উত্তর কোরীয় নেতা কিম ইল সুং চীনের শীর্ষ নেতৃবৃন্দের সাথে তার যুদ্ধনীতি অবগত করতে গোপনে পিকিং (বেজিং) সফর করেন । ১৯৫০ সালের অক্টোবরে উত্তর কোরিয়ার সমর্থনে চীন কোরীয় যুদ্ধে অংশ নেয় । কোরীয় যুদ্ধ জাতিসংঘ কমান্ডের বিপক্ষে চীনের গনস্বেচ্ছাসেবীরা লড়াই করে । এছাড়া চীন উত্তর কোরিয়ার উদ্বাস্তু ও শিক্ষার্থীদের অধিগ্রহনের পাশাপাশি যুদ্ধে আর্থিক সহায়তা প্রদান করে । ১৯৫৩ সালে কোরিয়া যুদ্ধ বিরতি স্বাক্ষরের পর সৌভিয়েত নেতৃত্বাধীন পূর্ব ব্লকের সদস্যদের সহযোগীতায় চীন উত্তর কোরিয়ায় পূর্ণবাসন ও বিপূল আর্থিক সহায়তা প্রদান করে । ১৯৫৬ সালের আগষ্ট থেকে ১৯৬০ পর্য্যন্ত চীন ও উত্তর কোরিয়ার মধ্যে সম্পর্কে চিড় ধরে । অবশেষে ১৯৬১ দুই দেশের মধ্যে পারস্পরিক সাহায্য ও বন্ধুত্বপূর্ণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় । চুক্তিতে চীন তার মিত্রদেশ উত্তর কোরিয়ার উপর যে কোন বৈদেশিক আক্রমনে তাৎক্ষনিক সামরিক ও সকল প্রকার সহায়তা সরবরাহের প্রতিশ্রতি ব্যক্ত করে ।
.
●●উত্তর কোরিয়ার পরমানু অস্ত্র : উত্তর কোরিয়া পরমানু অস্ত্র অর্জন পশ্চিমারা সহজভাবে মেনে নিতে পারছেনা । এছাড়া দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপান উত্তর কোরীয় পরমানু অস্ত্র অর্জনে শঙ্কিত । ওয়াশিংটন উত্তর কোরীয় পরমানু অস্ত্র অর্জনে চীন, রাশিয়া এবং পাকিস্তানের পরমানু অস্ত্রের জনক ড. কাদের খানকে দায়ী করছে । পশ্চিমাদের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুল প্রদর্শন করে উত্তর কোরিয়া বেশ কয়েকবার পারমানু বোমার পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণ ঘটায় । এরপর শুরু হয় কোরীয় উপদ্বীপে পরাশক্তির কুটনৈতিক ও সামরিক রণপ্রস্তুতি । মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প উত্তর কোরিয়ায় হামলার হুমকি প্রদানের বিপরীতে উত্তর কোরীয় কমিউনিস্ট নেতা মার্কিন ভূখন্ড জ্বালিয়ে দেয়ার দম্ভোক্তি প্রকাশ করেন । এরিমধ্যে কোরীয় উপদ্বীপে সমরসজ্জা বৃদ্ধি পায় । ডোনাল্ড ট্রাম্প বাহিনী উত্তর কোরিয়ায় হামলা চালালে এর সাথে যুক্ত হবে দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপান । কিন্তু কোনক্রমে যুদ্ধ বাঁধলে জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া যে দোজখে পরিণত হবে - সেটা ট্রাম্প প্রশাসন ভাল করে জানেন । শুধু তাই নয়, হামলা হলে চীন উত্তর কোরিয়ার পক্ষে যুদ্ধ করবে । আর এ সূযোগে রাশিয়া জাপানের বেশকিছু ভূখন্ড দখল করবে । যুদ্ধে মার্কিন বাহিনীর সলিল সমাধি ঘটবে । এসব বিষয় মাথায় রেখে ডোনাল্ড ট্রাম্প কুটনৈতিক কৌশলে ঝুঁকছে ।
দুই কোরীয় প্রেসিডেন্টের ঐতিহাসিক বৈঠক থেকে রাতারাতি সূফল মিলবেনা । যেহেতু উত্তর কোরিয়ার রিমোর্ট চীনের হাতে । এছাড়া পুতিনও চাইবেনা ট্রাম্পের কথায় উত্তর কোরিয়া পরমানু কর্মসূচী বর্জন করুক ।
.
উল্লেখ্য, উত্তর কোরিয়ার ৮৫% বাজার চীনের নিয়ন্ত্রণে । ফলে দুই কোরিয়ার মধ্যে ব্যবসা বানিজ্য চুক্তি আদৌ সফলতা আসবেনা । মূলত: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দুই কোরিয়ার মধ্যে সৃষ্ট ফাটল সাময়িক জোড়াতালি দেয়া হলেও সেটা দীর্ঘস্থায়ী শান্তির বার্তা সূদূর পরাহুত । বস্তুত উত্তর কোরিয়া হচ্ছে চীন ও রাশিয়ার ট্রাম্প কার্ড । ওয়াশিংটন ও তার মিত্রদের হুমকির মুখে রাখাই মূল উদ্দেশ্য । অপরদিকে ওয়াশিংটন কখনো উত্তর কোরিয়ায় হামলা করলে জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া ধ্বংশস্তুপে পরিণত হবে । শিল্প সমৃদ্ধ জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া কখনো উত্তরের সাথে যুদ্ধে জড়াতে চাইবেনা । এদু’টি দেশ উত্তর কোরিয়ার সাথে শন্তিপূর্ণ আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সমাধানে বিশ্বাসী । এছাড়া জাপান ও দক্ষিণ কোরীয় জনগনের মধ্যে মার্কিন বিরোধী মনোভাব প্রকট । দুই দেশে অবস্থিত মার্কিন সামরিক ঘাঁটির প্রত্যাহারের দাবীতে টোকিও ও সিউলে লাখ লাখ শান্তিকামী জনতার বিক্ষোভ মিছিল লক্ষনীয় ।
__________________________________
কোরিয়া উপদ্বীপে ‘শান্তির সুবাতাস’
Tags
# Recent Update
# Written Preparation
Share This
Written Preparation
Labels:
Recent Update,
Written Preparation